হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) ছাত্রীনিবাস

দেড় শতাব্দীর সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী উপমহাদেশের বৃহত্তম ও গৌরবোজ্জল নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইডেন মহিলা কলেজ। নারী শিক্ষার্থীদের আত্মপ্রত্যয়ী ও আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৮৭৩ সালে তৎকালীন গভর্নর স্যার এ্যাশলে ইডেনের নামানুসারে ‘ইডেন গার্লস স্কুল’ হিসেবে যাত্রা শুরু করে বেশ কয়েকবার স্থান পরিবর্তনের পর ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান অবস্থান ঢাকার আজিমপুরে স্থায়ী হয়। ইডেন গার্লস স্কুল নামে যে চারা গাছ রোপিত হয় আজ তা পত্র পল্লবে সুশোভিত এক বিরাট মহীরুহ। আজিমপুর এলাকার বিশাল জায়গা জুড়ে অসংখ্য বৃক্ষরাজি শোভিত ছায়াঘেরা মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে এই কলেজটি অবস্থিত। রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত শিক্ষার্থীরা এই বিদ্যাপীঠে অধ্যয়নরত। ছাত্রীদের আবাসন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে স্থাপিত ৬টি ছাত্রীনিবাসের মধ্যে আয়তনে সর্বকনিষ্ঠ হলো ‘হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা:) ছাত্রীনিবাস’  যা কলেজের প্রাণকেন্দ্র্র পুকুরের পূর্ব পাশে অবস্থিত। আয়তনে ছোট হলেও আলো ছায়াঘেরা শান্তিময় ও মনোরম পরিবেশে এর অবস্থান।

২০০৬ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর  শুভ উদ্বোধন এবং ১লা ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে এই ছাত্রীনিবাসটির কার্যক্রম শুরু হয়। আজ থেকে প্রায় ১৪০০ বছর পূর্বে আরব সমাজে নারী শিক্ষার পথিকৃৎ, বিদূষী, ক্ষণজন্মা মহিয়সী নারী উম্মুল মোমেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা:) এর নামানুসারে ছাত্রীনিবাসটির নামকরণ করেন তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রফেসর জাহান-ই-গুলশান মাহমুদা খানম। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা:) ছিলেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (সা:) এর সহধর্মিনী। তিনি অসংখ্য সহীহ হাদিসের সংগ্রাহক। এরকম একজন মহিয়সী ও বিদূষী নারীর নামে ইডেন মহিলা কলেজে একটি ছাত্রীনিবাসের নামকরণ হওয়ায় আমরা আনন্দিত ও গর্বিত। এই ছাত্রীনিবাসের উদ্বোধন ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা:) ছাত্রীনিবাসটি ৪তলা বিশিষ্ট এবং দুইটি (‘এ’, ‘বি’) ব্লকে বিভক্ত। ৪৪টি কক্ষে ৩৬০ জন শিক্ষার্থীর আবাসন ব্যবস্থা আছে। এখানে রয়েছে একটি অফিস কক্ষ, সম্প্রতি এটি নবরূপায়ন করা হয়েছে। এছাড়া রয়েছে একটি নামাজ কক্ষ, একটি ডাইনিং হল এবং একটি রিডিং রুম। রিডিং রুমে বাংলা, ইংরেজি  দৈনিক পত্রিকা রাখা হয় যা ছাত্রীদের মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশে সহায়তা করে। কক্ষের স্বল্পতার কারণে ডাইনিং হলেই ছাত্রীদের বিনোদনের জন্য টিভি দেখার ব্যবস্থা রয়েছে। ডাইনিং হলে ক্যাফেটেরিয়া সিস্টেমে ছাত্রীরা নিজ নিজ পছন্দ ও সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিবেলায় খাবার কিনে খেতে পারে। ছাত্রীদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের নিশ্চয়তায় হোস্টেল কর্তৃপক্ষ, উপদেষ্টামন্ডলী এবং ভিজিল্যান্স টিম নিয়মিত খাবারের মান পর্যবেক্ষণ করেন। ছাত্রীদের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষার সুবিধার্থে সি.সি ক্যামেরা ¯থাপন করা হয়েছে। করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি ও নিরাপত্তা জোরদার করণে তাপমাত্রা মাপার সেন্সর মেশিন বসানো হয়। সম্প্রতি ছাত্রীদের হাইজেন স্যানিটারী ন্যাপকিন হিসেবে সহজলভ্য প্রক্রিয়ায় ভেন্ডিং মেশিন বসানো হয়েছে যা ছাত্রীনিবাসে স্বস্তিদায়ক পরিবেশ তৈরি করেছে। ছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় একজন চিকিৎসক ও একজন কাউন্সিলর নিয়োজিত আছেন।
প্রহরীদের স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বসবাসের জন্য একটি কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে, একই সাথে গার্ডরুম সংলগ্ন একটি স্টোর রুম নতুনভাবে নির্মাণ করা হয়। আবাসিক ছাত্রীদের পানির সমস্যা সমাধানের জন্য ‘বি’ ব্লকের পানির ট্যাংকি সংস্কার করে নতুনভাবে তৈরি করা হয়েছে। ছাত্রীনিবাসের পরিসর ছোট হলেও এর মধ্যে আম, জাম, কাঠাল, নারিকেলসহ বিভিন্ন ফলের গাছ রয়েছে। ফলের মৌসুমে প্রশাসনের তত্বাবধানে ফল সংগ্রহ করে ছাত্রীদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হয়, ছাত্রীরা তা আনন্দের সাথে উপভোগ করে। ছাত্রীনিবাসের সামনে যে বিশাল পুকুর রয়েছে তাতে প্রতি বছর ‘মৎস্য সপ্তাহে’ মাছ অবমুক্ত করা হয় এবং বছরে একবার আনন্দঘন পরিবেশে মাছ উত্তোলন করে আবাসিক ছাত্রীদের মধ্যে বন্টন করা হয়। প্রতি বছর ভাবগাম্ভীর্যের সাথে ‘শবে বরাত’ পালিত হয় এবং সকল ছাত্রী ও কর্মচারীদের মধ্যে তাবারক বিতরণ করা হয়।
১লা ডিসেম্বর, ২০১৯ থেকে তত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করছি আমি প্রফেসর নাছিমা বেগম, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ। সহকারী তত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জনাব মোছা: জাহানারা খাতুন, সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ। এছাড়াও এখানে কর্মরত আছেন একজন অফিস সহকারী, ২জন নিরাপত্তা প্রহরী, ১জন প্লাম্বার, ৪জন ক্লিনার (১জন খন্ডকালীন),  ১জন ইলেকট্রিশিয়ান। তাদের প্রত্যেকের আন্তরিক সহযোগিতা ও প্রচেষ্টায় ছাত্রীনিবাসটির সার্বিক কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে। সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকে ছাত্রীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও সেবাদান করা যাতে আবাসিক ছাত্রীরা একাডেমিক ফলাফল ভাল করে আত্মনির্ভরশীল মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে।
বর্তমানে শ্রদ্ধাভাজন অধ্যক্ষ প্রফেসর সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য্য মহোদয় ছাত্রীনিবাসটির ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিক। ছাত্রীনিবাসের যে কোন সমস্যায় তিনি সবসময় তৎপর থাকেন ও সুচিন্তিত মতামত দিয়ে থাকেন। সম্মানিত উপাধ্যক্ষ প্রফেসর ফেরদৌসী বেগম ছাত্রীনিবাস পরিচালনায় অত্যন্ত আন্তরিকভাবে সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে থাকেন। অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ মহোদয় কলেজের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি ভিজিল্যান্স টিম গঠন করে দিয়েছেন। তারা নিয়মিত ছাত্রীনিবাস পরিদর্শন করেন এবং ছাত্রীনিবাসের নিয়ম শৃঙ্খলা ও সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে সাহায্য করেন।
ছাত্রীনিবাসটি ক্ষুদ্রায়তনবিশিষ্ট হওয়ায় এখানে আলাদা টিভি রুম ও ছাত্রীদের  বিনোদনের জন্য কমনরুমের অভাব রয়েছে। স্থান স্বল্পতাহেতু এখানে উন্মুক্ত প্রাঙ্গন ও বাগানের অভাব রয়েছে। সম্মানিত অধ্যক্ষ মহোদয়ের আন্তরিকতায়  ইতিমধ্যে সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, জাতীয় বিভিন্ন দিবস উদযাপনে, সৃজনশীলতা বিকাশে এই ছাত্রীনিবাসের ছাত্রীদের সাফল্য ও নৈপুন্য প্রশংসনীয়। এই হোস্টেলের ছাত্রীরা পড়াশুনা শেষ করে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে উচ্চ পর্যায়ে নিজেদেরকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে তাদের দক্ষতা ও পারদর্শিতা দ্বারা দেশ ও জাতির কল্যানে যেন নিয়োজিত করতে পারে সেই প্রত্যাশা করছি।