ইতিহাস

ইডেন মহিলা কলেজ একটি প্রাখ্যাত প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিগত এক শতাব্দিতে যে শিক্ষিত, জাগ্রত, সচেতন, স্বাধীন চিন্তামনস্ক অগ্রসারমান নারীসমাজ এদেশে গড়ে উঠেছে তার মৃত্তিকাগর্ভ ইডেন মহিলা কলেজ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ, প্রতিবাদী ও সাহসী ভূমিকা রয়েছে। বর্তমানেও দেশচালনা, প্রশাসন, রাজনীতি, শিক্ষা, গবেষণা, বিজ্ঞান-প্রকৌশল-আদিপত্য-প্রযুক্তি, পুলিশ তথা কর্মের সকল ক্ষেত্রে ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রীদের রয়েছে গর্বিত বিচরণ।

নারী শিক্ষার বৃহৎ ও অনন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইডেন মহিলা কলেজের ১৫০ বছরের পথ পরিক্রমণের ইতিহাস রয়েছে। ‘শুভস্বাধিনী সেবা’ নামক সংঘের নারীহিত চিন্তা থেকে ১৮৭৩ সালে স্বল্পসংখ্যাক বিদ্যার্থী নিয়ে একটি ক্ষুদ্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভূমিষ্ঠ হয়েছিল তা আজ মহাগৌরবে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। শিক্ষাহিতৈষী Miss Mary Corpenter GB এই গৃহ-বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করে আর একটি স্কুল স্থাপনের পক্ষে রিপোর্ট পেশ করেন। ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিনিধি শ্রী নবকান্ত আনন্দ মোহন দাস প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয় একত্রিত হয়ে ঢাকা ফিমেল (Dhaka Female) স্কুল নামে আত্মপ্রাকশ করে। ১৮৭৮ সালে নতুন ব্যবপনায় তৎকালীন গভর্নর স্যার অ্যাশলে ইডেনের নামানুসারে নতুন নামকরণ করা হয় ইডেন গার্লস স্কুল। ১৮৭৮ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ‘ইডেন গার্লস স্কুল’ সরকারি প্রতিষ্ঠানে রূপ পায়। ইডেন স্কুলই সেকালের প্রথম সরকারি বিদ্যালয়। ১৮৯৬-৯৭ সালে এর ছাত্রী সংখ্যা ছিল ১৩০ জন । ১৯০৭-১৯১২ সনের রিপোর্ট অনুযায়ী Province of Easter Bengal and Assam Gi এর মধ্যে ইডেন স্কুলকে Excellente High School হিসেবে অভিহিত করা হয়। তখন স্কুলের কার্যক্রম পরিচালিত হতো লক্ষীবাজারের একটি বাসায়। ১৮৯৭ সালে ভায়াবহ ভূমিকম্পে বাসাটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রথমে উকিল শ্রী ঈশ্বরচন্দ্রের বাসায় ও পরে সদরঘাটে পর্তুগিজ কুঠি বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। এ সময়ে স্কুলটি ইন্টারিমিডিয়েট শ্রেণিতে উন্নীত হয় এবং ইডেন গার্লস হাই স্কুল অ্যান্ড ইন্টারমিডিয়েট কলেজ নামাঙ্কিত হয়। ১৯৩৯-৪০ এর শিক্ষার্থীদের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায় প্রশস্ত একটি বাগানের মাঝে তিতল অট্টালিকা ছিল কলেজ ভবন। সঙ্গে খেলার মাঠ ও Assembley হল। ১৯৪৫ সালে পুনর্বার স্কুলটি স্থানান্তরিত হয় আবদুল গণি রোডের বর্তমান সবিালয়ে। সচিবালয়ের নাম আজো ইডেন বিল্ডিং। ১৯৪৭ সালে স্কুলটি কার্জন হলে কিছুদিন তারপর কামরুন্নেসা স্কুল টিকাটুলীতে অবস্থান করে।

১৯৪৮ সালে ইডেন স্কুল ও কলেজের কলেজ শাখা ও কামরুন্নেসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের কলেজ শাখা যুক্ত হয় ইডেন গার্লস কলেজ রূপে ৭নং বকশীবাজারে । অবশেষে এ প্রতিষ্ঠান ১৯৬২ সনে আজিমপুরে ১৮ একর জমিতে স্থায়ী ঠিকানা লাভ করে।

বিভিন্ন পর্যায়ে এ কলেজের অধ্যর্ক্ষে দায়িত্ব পালন করেছেন দেশের শীর্ষ নারী ব্যক্তিত্ব। তাঁদের জ্ঞানে-প্রজ্ঞায়, মেধায়-দুরদর্শিতায় বিদ্যায়তনটিকে সুনামের শিখরে পৌঁছে দিয়েছেন। দেশখ্যাত শিক্ষকগণ এখানে পাঠদান করেছেন। তাঁদের অবদান অবিস্মণীয়। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে স্মরণীয় ফজিলাতুন নেসা জোহা, অধ্যাপক জেবুন্নেসা রহমান, অধ্যাপক খোদেজা খাতুন, অধ্যাপক রাজিয়া বেগম, অধ্যাপক ড. আয়েশা খাতুন, অধ্যাপক সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য্য প্রমুখ।
ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী বাংলাদেশের দীপ্তময়ী নারী ব্যক্তিত্ব; যারা সমাজ সংস্কৃতি-সাহিত্য-রাজনীতির জগতের উজ্জল নক্ষত্র তাঁরা হলেন- নীলা নাগ, প্রতিলতা ওয়াদ্দেদার, কমলা সেন, হেলেনা দত্ত, মতিয়া চৌধুরী, সুফিয়া করিম, মাফরুফা চৌধুরী, খোদেজা খাতুন, ড. সনজিদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন, ফেরদৌসী রহমান, রুশন জামিল, লায়লা হাসান, ফেরদৌসী মজুমদার, রাণী হামিদ, ডলি জহুর প্রমুখ।

দীর্ঘ ১৫০ বছরে ইডেন মহিলা কলেজের দৃশ্যমান ব্যপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বর্তমানে ২৩টি বিভাগে ২৪ হাজারের অধিক ছাত্রী অধ্যয়ন করছে। শিক্ষক সংখ্যা ২৫২ জন, প্রশাসনিক ভবন ও একাডেমিক ভবন ৬টি, ১টি বহুতলসহ ৬টি ছাত্রীনিবাস। প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটেছে প্রশাসনিক কাজে ও শ্রেণিকক্ষে। শিক্ষার্থীদের দৈহিক-মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। রয়েছে সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র ছায়াবিথী, বিএনসিসি, বাঁধন ইত্যাদি। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো সর্বদা সক্রিয়। সময়ের বৈরিতা মোকাবেলা করে ইডেন মহিলা কলেজ শিক্ষা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নতুন সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে উন্নয়নের পথে অগ্রসরমান।